শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের গুরুত্ব নির্ণয় করো।

শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের গুরুত্ব/মূল্য:

শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত মনোযোগ আমাদের মানসিক পরিশ্রমকে কমিয়ে দেয়। মনোযোগের কারণেই আমাদের মন বিক্ষিপ্ত হতে পারে না। যদি আমাদের মন প্রতিনিয়ত বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে বিক্ষিপ্ত হতো, তাহলে আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতো। আর মনোযোগের জন্যই আমরা কোনো বস্তু সম্পর্কে একক সামগ্রিক জ্ঞানলাভে সমর্থ হই। তাই মনোযোগ ছাড়া শিক্ষা অসম্ভব। শিক্ষার্থীদের যদি পাঠের প্রতি মনোযোগী করে তোলা সম্ভব না হয় তাহলে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। উন্নত শিক্ষণ কৌশল প্রয়োগ করেও কোনো সুফল মিলবে না। মনোযোগই হলো শিক্ষার প্রাথমিক শর্ত। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষাগ্রহণকালে শিক্ষার্থীরা যদি অমনোযোগী হয়ে পড়ে তাহলে শিক্ষাদান কার্যত ভীষণভাবে ব্যাহত হবে। এসময় যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা এইরূপ-

• ইচ্ছানিরপেক্ষ মনোযোগ ও শিক্ষা:

বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মনোযোগের বিকাশ ঘটে। প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর মধ্যে যে মনোযোগ চোখে পড়ে তা মূলত ইচ্ছানিরপেক্ষ মনোযোগ। এই ধরনের মনোযোগ শিশুর ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এসময় শিশু প্রকৃতির তাড়নায় কোনো বস্তুর প্রতি আগ্রহী হয়। মূলত কৌতূহল নিবৃত্তি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবৃত্তি দু’টি এক্ষেত্রে ভীষণভাবে সক্রিয় থাকে। তাই এসময়ে জোর করে অন্য বস্তুর প্রতি মনোযোগ ফেরাবার চেষ্টা করা হলে তা কোনো কাজেই আসবে না। এই প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে শিশু যে-সমস্ত বস্তু বা বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয়, সেই বস্তুকে কেন্দ্র করেই তার জন্য শিক্ষা-পরিকল্পনা রচনা করতে হবে।

• ঐচ্ছিক মনোযোগ ও শিক্ষা

যেহেতু মনোযোগ ব্যক্তির জীবনে ধীরে ধীরে বিকাশিত হয়, তাই পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে ঐচ্ছিক মনোযোগ গড়ে ওঠে সেইদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ মনোযোগের বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়ে ঐচ্ছিক মনোযোগের বিকাশ সম্পন্ন হয়। ঐচ্ছিক মনোযোগ হলো এমন এক ধরনের মনোযোগ যেখানে শিক্ষার্থীর মনোযোগ তার ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত ও নির্ধারিত হয়। এই ধরনের মনোযোগের জন্য ইচ্ছা বা সংকল্পের প্রয়োজন হয়। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইচ্ছাকৃতভাবে মনোযোগের বিষয়বস্তু বাছাই করে। এধরনের মনোযোগের জন্য বিশেষভাবে শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কারণ স্বাভাবিকভাবে এই ধরনের মনোযোগ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আসে না। তাই শিক্ষকের কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিকে কেন্দ্র করে ঐচ্ছিক মনোযোগ গড়ে ওঠে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। পাঠে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে এই ধরনের মনোযোগ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষার লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, পাঠের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে পারলেই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পাঠে মন দেবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐচ্ছিক মনোযোগের বিকাশ ঘটাতে হলে প্রথমে ইচ্ছানিরপেক্ষ মনোযোগকে ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে এবং পরের পর্যায়ে আদর্শবোধ জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে ঐচ্ছিক মনোযোগকে কার্যকরী করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের মনোযোগ একবার জাগ্রত হলে তা সারা জীবন ধরে তাদের জ্ঞানার্জনে অনুপ্রাণিত করবে।

• বিবিধ অভিজ্ঞতার উপরিপাত ও শিক্ষা

পরিশেষে এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে মনোযোগী করে তুলতে যতটা সম্ভব কম সংখ্যক বিষয়ে তাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত হতে সাহায্য করা উচিত। কারণ মনোযোগের পরিসরের একটি সীমা আছে। একই সঙ্গে একাধিক বস্তুর প্রতি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। আর যদি জোর করে তা করার চেষ্টা করা হয়, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার উপরিপাতের ফলে প্রয়োজনের সময়ে দরকারি বিষয়গুলি মনে না-ও পড়তে পারে। সেজন্য বিষয়বস্তু এমনভাবে বাছাই করতে হবে যাতে মনোযোগের পরিসরের ক্ষেত্রটিকে ছাপিয়ে না যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মনোযোগকে সক্রিয় করতে হলে তার বিভিন্ন নির্ধারক বা শর্ত, যেমন- উদ্দীপকের তীব্রতা, বিস্তৃতি, পুনরাবৃত্তি, গতিশীলতা, স্পষ্টতা ইত্যাদিকে যথাযথভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। তবেই শিখন প্রক্রিয়া কার্যকর হবে। কারণ শিখনের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত মনোযোগ। মনোযোগ ব্যতীত কোনো অবস্থাতেই শিখন সম্ভব নয়।

Leave a Comment